“মানিক মিয়া এভিনিউ না বাঙালির মুখপাত্র মানিক মিয়া”বাংলাদেশের কাছে এই রাস্তাটি সুপরিচিত হলেও মানিক মিয়া পরিচয় আড়ালেই ঢেকে গেছে। বর্তমান বাংলাদেশে একটি রাস্তাই শুধু মানিক মিয়া। দৈনিক ইত্তেফাক এবং যারা জানেন বুঝেন তারাও কি মানিক মিয়ার ইতিহাস আমাদের সঠিকভাবে জানিয়েছেন। নিশ্চয় না। বাংলাদেশের জন্মে যে দলের ভূমিকাই প্রধান তারাও কি স্মরণ করেন? অথচ সে দলের সাথে তার কি সম্পর্কই ছিল। অন্যদলগুলোর নেতাকর্মীরা কি জানেন বাংলাদেশের জন্যে এই মানুষটির অবদান। উত্তর, না। যে জাতি তার জন্ম ভুলে যায় সে জাতির মেরুদণ্ড সোজা হয় না কোনদিন। আমরা!তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই মা হারিয়ে বাবা মুসলেম উদ্দিন মিয়াই হয়ে উঠেন তার আশ্রয়। তবে পারিবারিক ভাবে তাঁর স্নেহের অভাব হয়নি। “উঠন্ত মূল পত্তনেই চেনা যায়” প্রবাদটি তার শৈশবের কথা বলে। পূর্ব ভাণ্ডারিয়া প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি সহচর ও সহপাঠীদের অবিসংবাদিত ক্ষুদে নেতা হয়ে উঠেন। ভাণ্ডারিয়া প্রাইমারি স্কুল, ভাণ্ডারিয়া হাই স্কুল, পিরোজপুর সরকারি হাইস্কুলে তার পদচারণা। ১৯৩৫ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে বি.এ পাস করে পিরোজপুর সিভিল কোর্টের চাকরির মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এর পর থেকেই সেই অবিসংবাদিত ক্ষুদে নেতার আসল পরিচয় পরিস্ফুটিত হতে থাকে। একটি ঘটনার কথাই বলা যাক, কোর্টের মুন্সেফ তাঁর প্রতি অবমাননাকর আচরণ করলে তিনি এর প্রতিবাদে চাকরিতে ইস্তফা দেন। মুন্সেফ তার কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে এডভোকেট আফতাবউদ্দিন সাহেবের সহযোগিতায় তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনেন৷ হ্যাঁ এটাই মানিক মিয়া, অন্যায়ের কাছে মাথা নত তিনি করতে শিখেন নি।মানিক মিয়া রাজনীতিতে যুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে। তবে তিনি প্রতক্ষ্য রাজনীতিতে তেমন কোন ভূমিকা না রাখলেও তিনি ছিলেন পাকিস্তান ও বাঙলার রাজনীতির অন্যতম প্রভাবক। শহীদ সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি কোর্টের চাকরি ছেড়ে বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে চাকরি নেন। এরপর শহীদ সাহেবের পরামর্শেই তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এখান থেকেই উপমহাদেশের রাজনীতির সাথে তাঁর যোগসাজশ। রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি শহীদ সাহেবের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগোত্তর পাকিস্তানে মূখ্যমন্ত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শহীদ সাহেব পরাজিত হলে তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের বিরাগভাজন হন এবং মুসলিম লীগ থেকে ইস্তফা দিয়ে আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত “ইত্তেহাদ” পত্রিকায় সেক্রেটারি হিসেবে যোগদান করেন। দৈনিক ইত্তেহাতে যোগদান প্রসঙ্গে শহীদ সাহেব তার সম্পর্কে বলেন, “মানিক মিয়া সত্যি মানিক মিয়া….সাংবাদিকতায় তার অভিজ্ঞতা নাই সত্য কিন্তু অফিস ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা দেখিয়া তোমরা মুগ্ধ হইবে”।ইত্তেহাদে তিনি একবছরের মতো কাজ করেছিলেন। এরপর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে দলের মুখপত্র রূপে সাপ্তাহিক ” ইত্তেফাক” প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে মানিক মিয়া এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৯৫২ সালে তিনি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্মেলনে পাকিস্তানের অন্যতম সদস্য হিসেবে চীন সফর করেন। ১৯৫৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা ও পরামর্শে তিনি “দৈনিক ইত্তেফাক” প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। তফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন রাজনীতিক। রাজনীতি করার জন্য তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করেন এবং রাজনীতি করার জন্যই সাংবাদিকতার অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তবে সক্রিয় রাজনীতির পন্থা তিনি গ্রহণ করেননি’। তার রাজনীতি ছিল স্টেটসম্যানের রাজনীতি পলিটিশিয়ানের নয়। দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অর্জন ছিল তাঁর জীবনদর্শন। জনগণের বিশেষ করে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও বাংলাদেশের(তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অধিকার বঞ্চিত জনগণের অধিকার অর্জনে তার সংগ্রামী ও ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা ছিল তীব্রতায় ও সামগ্রিক ব্যাপকতায় অতুলনীয়। মানিক মিয়া এ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্যতম আদি ও অকৃত্রিম প্রবক্তা। তিনি বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রামী ভূমিকা পালনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন ছাড় দেন নি। এই সংগ্রামী ভূমিকা পালনের জন্য রাজনৈতিক অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে তাকে বারবার নিগৃহীত হতে হয়েছে, তাঁর পত্রিকা বন্ধ হয়েছে, ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তিন তিনবার তাকে সারাজীবন ভোগ করতে হয়েছে তবে তিন বারই তিনি বেকসুর মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের পর প্রথমবারের মতো ইত্তেফাকের প্রকাশনা কিছুকালের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে বন্ধ রাখা হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে হাজার ১৯৫৯ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর সামরিক আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অভিযোগে তাকে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তারের পর দেশে গণবিক্ষোভ বিক্ষোভ শুরু হলে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য ইত্তেফাক ব্যাপক কার্যক্রম চালায়। গণবিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানিক মিয়ার ১৯৬৩ সালে আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিছুকাল পাকিস্তান প্রেস কোর্ট অফ অনার এর সেক্রেটারির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এছাড়া তিনি প্রায় দুই বছর কাল পিআইএ(Pak International Airlines) এর ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের স্বৈরাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ৬দফা আন্দোলনের মূলউৎপাটনের জন্য তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ৬ দফার ন্যায্য দাবিগুলো ইত্তেফাকের প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তারই প্রেক্ষিতে হাজার ১৯৬৬ সালের পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। সরকার কর্তৃক তার নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয় ফলে ইত্তেফাফসহ অপর দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস এবং পূর্বানী বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের ২৯ শে মার্চ অসুস্থ মানিক মিয়াকে ঢাকা পুলিশ হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি লাভের পর তিনি পাকিস্তানি রাজনীতি ও বিভিন্ন বিষয়ে উপর নিজের অভিজ্ঞতার এক পাণ্ডুলিপি নিরুপণ করেন। যা পরবর্তীতে “পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সুদীর্ঘ দু’বছর সাত মাস পর গণ আন্দোলনের ফলে সরকার বাধ্য হয়ে প্রেস মুক্ত করে দেন এবং ইত্তেফাকসহ তিনটি পত্রিকার পুনঃপ্রকাশের সুযোগ ঘটে। ১৯৬৯ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাকের পুনর্জন্ম হয়। তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েই আবার তার ক্ষুরধার লেখনী ধারণ করেন এবং নতুন করে পত্রিকার পুনর্গঠন ও পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন এ সময় দৈহিক পরিশ্রম ও মানসিক অশান্তির ভগ্ন স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের অবিসংবাদিত নেতা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ২৬ শে মে তিনি গমন করেন এবং সেখানে ৩১ শে মে রাতে আকস্মিকভাবে তাঁর জীবনের অবসান ঘটে।আসছে,”পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর”